
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’—কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার এ লাইন যেন চিরসত্যের চরম শিখরে এ সময়ে। খাদ্যাভাব নেই, তবে অর্থের অভাব এসে ভর করেছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। ফলস্বরূপ প্রয়োজনীয় খাবার সামনে থাকলেও পকেটের দিকে তাকিয়ে শুধু দেখে যেতে হচ্ছে বাজারের সারিবদ্ধ দোকানগুলোর দিকে। আজকের দিনে দেশের বহুমুখী উন্নয়ন হলেও এ দেশের বহুসংখ্যক মানুষই অপর্যাপ্ত আয়ের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানের বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। এ সব মানুষের দুর্দিন ক্রমশই ঘনিয়ে আসছে নিত্যদিনের অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য ভারসাম্যহীনতার কারণে।
বলছি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কথা।
ফের মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে দাম। পরিস্থিতি এমন যে, খুচরা বাজারে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ডিমের ডজন কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৭০ টাকা, যা সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ টাকা বেশি। এছাড়া বাজারে হু হু করে বাড়ছে ভোজ্যতেল, আলু ও চিনির দাম।
সবজি কিনতেও ক্রেতার বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। রবিবার (৬ অক্টোবর) টাঙ্গাইলের পার্ক বাজার, সিটি বাজার, ছয়আনী বাজার, আমিন বাজারসহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে সরকার ১৫ সেপ্টেম্বর ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী, প্রতিডজনের খুচরা মূল্য ১৪২ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতি ডজন বাদামি রঙের ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৭০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ১৬০ টাকা ছিল। আর সাদা রঙের ফার্মের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৬৫-১৭০ টাকা, যা সাত দিন আগে ১৫৫-১৬০ টাকা ছিল। সেক্ষেত্রে উভয় ডিমের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে, যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২৮ টাকা বেশি।
পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা, যা সাত দিন আগেও ১৮০ টাকা ছিল। বাজারে ডিম কিনতে আসা আসলাম শেখ বলেন, কয়েকদিন পরপর ডিমের দাম বাড়ানো হয়। ১৭০ টাকা ডজন যদি ডিমের দাম হয়, তাহলে কী করে কিনব। আর দোকানিরা এক পিস ডিম ১৫ টাকা করে বিক্রি করছেন। তিনি জানান, টেলিভিশন ও নিউজ পোর্টালে শুধু সরকারের মূল্য নির্ধারণ করার সংবাদ পাই। কিন্তু বাজারে এসে নির্দারিত দামে পণ্য কিনতে পারি না। তাহলে কী কারণে মূল্য নির্ধারণ করে।
একই বাজারের মুদি বিক্রেতা সুমন মিয়া বলেন, পাইকারি বাজারে কিন্তু ডিমের কোনো সংকট নেই। সরবরাহও পর্যাপ্ত। কিন্তু পাইকাররা বলছেন সরবরাহ কম। ডিম উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বাড়তি। তাই বেশি দামে ডিম এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে রাতারাতি অতি মুনাফা লুটে নিচ্ছে। এর খেসারত ভোক্তাকে দিতে হচ্ছে। দোকানিরা জানায়, কয়েক দিন টানা বৃষ্টির পর অতিরিক্ত গরম পড়ায় ডিমের উৎপাদন কমেছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কমে ডিমের দাম বেড়েছে।
এদিকে খুচরা বাজারে দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৩৩৫ টাকা, যা সাত দিন আগে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫১-১৫২ টাকা, যা সাত দিন আগে ১৪৮ টাকা ছিল। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সপ্তাহখানেক আগে ১৪০ টাকা ছিল। আর পাম তেল সুপার প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকা, যা সাত দিন আগে ১৪০-১৪২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পার্ক বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা সালাউদ্দিন বাদল বলেন, আগে তেলের দাম বাড়ালে রিফাইনারি কোম্পানি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তেলের দাম বাড়ানোর খবর প্রচার করত। এখন সেটা নেই বললেই চলে। তারা তাদের খেয়াল-খুশিমতো দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে নাজেহাল করছেন। খুচরা বাজারে সরবরাহ থাকলেও ফের আলুর দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয় ৬০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
দাম বাড়তে শুরু করেছে চিনিরও। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকা, যা আগে ১২৮-১৩৫ টাকা ছিল।
তবে কমেছে দেশি পেঁয়াজের দাম। খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০৫-১১০ টাকা, যা আগে ১০৫-১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া খুচরা বাজারে গোল বেগুন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা। আর লম্বা বেগুন প্রতিকেজি ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নতুন ফুলকপি প্রতি পিস ৭০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা, করলার কেজি ৮০-৯০ টাকা, প্রতিকেজি শালগম ১০০-১১০ টাকা, মূলা ১০০-১৩০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাঁচা কলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫৫ টাকা। প্রতিকেজি দেশি শসা ৮০-৯০ টাকা ও হাইব্রিড শসা ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে প্রতিকেজি গাজর বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৩০ টাকায়।
নিম্ন আয়ের মানুষের এই নিঃশব্দ হাহাকার কে শুনবে, দেখবে কে তাদের এই রংহীনতা? বেঁচে থাকাটাই যেন দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে সামনের পথে এগোতে গেলেই। যেসব পরিবারে মাত্র একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বিদ্যমান, সে ব্যক্তির পক্ষে আদৌ কি সম্ভব নিত্যদিনের এই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা? জীবনের নির্মম অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এসব মানুষকে প্রতিনিয়ত। এই অবস্থা চলমান থাকলে দেশের সাধারণ মানুষ হতাশ আর অসহায়ত্বের কিনারায় ডুবে মরবে। সাধারণ মানুষ মানসিকভাবেও নির্যাতিত হচ্ছে এর ফলে। দ্রব্যমূল্যের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই বর্তমানের এ সমস্যার সঠিক উপায়ন্তর হবে।